www.machinnamasta.in

ওঁ শ্রীং হ্রীং ক্লী গং গণপতয়ে বর বরদ সর্বজনস্ময়ী বশমানয় ঠঃ ঠঃ

April 20, 2025 6:59 pm
sri chaitanya

চৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬ খ্রিঃ – ১৫৩৩ খ্রিঃ) ছিলেন ভারতবর্ষে আবির্ভূত এক বহু লোকপ্রিয় বৈষ্ণব সন্ন্যাসী ও ধর্মগুরু মহাপুরুষ এবং ষোড়শ শতাব্দীর বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক। তিনি গৌড়বঙ্গের নদিয়া অন্তর্গত নবদ্বীপে (অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলা) হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শ্রীজগন্নাথমিশ্র ও শ্রীমতী শচীদেবীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলেই মধ্যযুগের আকাঙ্ক্ষিত সাংস্কৃতিক সম্মিলন সম্ভবপর হয়েছিল। তিনি ছিলেন পূর্ব এবং   উত্তরভারতের  এক মানবদরদী বৈষ্ণব সন্ন্যাসী ও ধর্মগুরু এবং ষোড়শ শতাব্দীর অন্যতম বিশিষ্ট  সমাজ সংস্কারক। এই মহান অভ্যুত্থানকে   ঐতিহাসিকরা বলছেন নবজাগরণ বা রেনেসাঁস অর এই রেনেসাঁসের প্রাণপুরুষ হলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য দেব।

চৈতন্যদেবের জন্ম | Birth

আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে(৮৯২ বঙ্গাব্দের ২৩শে ফাল্গুন),   দোলপূর্ণিমার দিন নবদ্বীপে শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাব হয়। পিতা ছিলেন জগন্নাথ মিশ্র ও মাতা শচী দেবী। শ্রী চৈতন্যের (Sri Chaitanya)  পিতৃদত্ত ডাকনাম নিমাই; ভাল নাম বিশ্বম্ভর। গায়ের রং উজ্জ্বল থাকার কারণে তাঁকে অনেকে ‘গৌরাঙ্গ’ বলেও ডাকতেন। বাল্যকালে নির্মাণ ছিলেন দুরন্ত। গদাধর পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করা হয় ছেলের দুরন্তপনা কমানোর বাসনাতেই। অনন্যসাধারণ প্রতিভার অধিকারী নিমাই অল্পবয়সে সর্ববিদ্যায় বিশারদ হয়ে ওঠেন। প্রগাঢ়  ছিল তাঁর পাণ্ডিত্য এবং পরবর্তীকালে তিনি শুরু করেন অধ্যাপনা (Spiritual)।

শিক্ষা | Education

কিশোর অবস্থায়  পিতৃহারা হন নিমাই। প্রথম যৌবন কালে পণ্ডিত নিমাইয়ের  প্রধান আগ্রহের বিষয় ছিল সংস্কৃত গ্রন্থাবলী পঠনপাঠন এবং জ্ঞানার্জন করা। তিনি ব্যাকরণশাস্ত্রে প্রভূত পাণ্ডিত্য  অর্জনের  করার ফলে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তিনি ছাত্রদের লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে  একটি টোল স্থাপন করেছিলেন। তর্কশাস্ত্রের ক্ষেত্রে  নিমাই পণ্ডিত ছিলেন অদ্বিতীয় খ্যাতিসম্পন্ন। দ্বিগ্বিজয় পণ্ডিত কেশব কাশ্মীরকে তরুণ নিমাই তর্ক-যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই শ্রীহরির জপ ও কীর্তনের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ ছিল নিমাই সন্ন্যাসীর।

বিবাহ ও নিমাইয়ের বৈপ্লবিক রূপান্তর

নিমাইয়ের  প্রথম ধর্মপত্নী লক্ষ্মীপ্রিয়াদেবীর  বিয়ের পর পূর্ববঙ্গে ভ্রমণকালে সর্পদংশনে মৃত্যু ঘটলে মাতা শচীদেবীর ইচ্ছা অনুসারে নিমাই  পুনরায় বিবাহ করেন বিষ্ণুপ্রিয়াকে।  এর অল্পকাল পরেই বিখ্যাত সাধক ঈশ্বর পুরীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় এবং তিনি ধীরে ধীরে কৃষ্ণভক্ত হয়ে ওঠেন।  ঈশ্বর পুরীর কাছে তিনি শ্রীশ্রীগোপাল অষ্টাদশাক্ষর মহামন্ত্রেরাজে দীক্ষিত হয়েছিলেন যা নিমাইয়ের পরবর্তী জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার (Spirituality) করেছিল।

গয়া ধামে বিষ্ণুর পাদপদ্ম দর্শনের ফলে তাঁর মনে আসে বৈপ্লবিক রূপান্তর। কৃষ্ণ প্রেমের ব্যাকুলতা নিয়েই তিনি মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে কাঞ্চননগরে স্বামী কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করে সংসার ত্যাগ করেন। তাঁর নতুন  নাম হয়,’শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য ‘বা সংক্ষেপে “শ্রী চৈতন্য”।

শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণভাব | Love for God

বাংলায়  ফিরে আসার পরবর্তীকালে নিমাই এর ভাবগত দিক দিয়ে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। পণ্ডিত থেকে কৃষ্ণভক্তরূপে (Sri Krishna) তাঁর এই ভাবমূর্তির আমূল পরিবর্তন দেখে স্থানীয় বৈষ্ণব সমাজ আশ্চর্যচকিত হয়ে পড়ে। খুব শীঘ্রই নিমাই নদিয়ার বৈষ্ণব সমাজের এক অগ্রণী নেতা হিসেবে পরিগণিত হন। বর্ণভেদ ও  জাতিভেদ উপেক্ষা করে তিনি সমাজের নিম্নবর্গের সকল মানুষকে বুকে জড়িয়ে ,নিজের করে নিয়ে  “হরি বল” ধ্বনি এবং হরিনাম প্রচারে মেতে উঠেছিলেন।অনুগামীদের সাথে নিয়ে  তিনি নবদ্বীপের (Nabadwip) রাজপথে ‘নগর সংকীর্তন’-এ বেরিয়ে পড়তেন । অত্যাচারী জগাই ও মাধাইও তাঁর  ভক্ত রূপে নিজেদের প্রতিপন্ন করেছিলেন। চৈতন্যভাগবত-এ উল্লিখিত আছে যে জাতিভেদের অন্তঃসারশূন্যতা প্রদর্শন করার জন্য তিনি শূদ্র রামরায়কে দিয়েও শাস্ত্র ব্যাখ্যা করিয়েছিলেন। 

সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর তিনি তাঁর জন্মভূমি নদিয়া ছেড়ে কিছু বছর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থানে পরিভ্রমণ করে থাকেন ;যেমন -নীলাচল, দাক্ষিণাত্য, পণ্ডরপুর, বৃন্দাবন প্রভৃতি তীর্থক্ষেত্র।   পরিভ্রমণের সময়কালে  তিনি সেই সব অঞ্চলের   ভাষা ; যথা: ওড়িয়া, তেলুগু, মালয়ালম প্রভৃতি তে বিশেষভাবে পারদর্শী হয়েছিলেন। 

কৃষ্ণনাম জপ ও  বৈরাগ্য সাধন ই তিনি অহোরাত্র করে যেতেন। জীবনের শেষ চব্বিশ বছরেের বেশির ভাগ সময় তিনি জগন্নাথ ধাম পুরীতেই অতিবাহিত করেছিলেন বলে শোনা যায় । অনেকে চৈতন্যদেবকে শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ  অবতার হিসেবেও মনে করতেন। ভক্তরা  এ ও মনে করতেন যে চৈতন্যদেব ভক্তিরসে  এতটাই  বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন যে জীবনের শেষ লগ্নে তিনি হরিনাম সংকীর্তন করার মুহূর্তে অধিকাংশ সময়েই   ভাবসমাধিস্থ হয়ে পড়তেন।

শ্রীচৈতন্য দেবের অবতার রূপ 

গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতানুযায়ী  , চৈতন্য মহাপ্রভুকে ঈশ্বরের তিনটি পৃথক রূপের আধার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

১)কৃষ্ণের ভক্ত রূপে,

২) কৃষ্ণভক্তির প্রবক্তা রূপে এবং

৩)রাধিকার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ কৃষ্ণের স্বরূপ হিসেবে।

কথিত আছে যে  তিনি একাধিকবার অদ্বৈত আচার্য ও নিত্যানন্দ প্রভুকে কৃষ্ণের ন্যায় বিশ্বরূপ দর্শন  ও করিয়েছিলেন।

চৈতন্যদেবের অবদান | Contribution to the society

শ্রীচৈতন্যদেব মানুষকে মানুষ হিসেবেই মূল্য দিয়ে বর্ণ শ্রেণিভেদে বিভক্ত আত্মবিচ্ছিন্ন বাঙালি জাতিকে একসূত্রে বাঁধার চেষ্টা করেছিলেন ।”মুচি হয়ে শুচি হয় যদি কৃষ্ণ ভজে”। তাঁর কৃষ্ণ ভজনা বা হরিভক্তি কোনোরূপ প্রথাগত ধর্ম নয়। মানুষের অন্তরের যে স্বাভাবিক প্রেমপ্রীতি তাকেই ভগবত- মুখী করাই ধর্ম।তাঁর ধর্মের ব্যাপারে এই সহজ সরল ব্যাখ্যা মানুষ গ্রহণ করতে পেরেছিল ।তাই তুর্কি আক্রমণের পরবর্তী ফলশ্রুতি হিসেবে বিশেষ সামাজিক পরিবেশে উচ্চ-নীচ ,অভিজাত- নিম্নবর্গের শ্রেনীর মধ্যে পারস্পরিক মিলন কামনা দেখা দিয়েছিল।

হিন্দুসমাজের উচ্চ ও নিম্ন বর্ণকে এক ধর্মাচারণে  সন্নিহিত করে চৈতন্য দেব এক  মিলন মূলক হিন্দু সমাজ গড়ে তুলতে সহায়তা করেন। তিনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল পুরুষ ও নারীকে নাম সংকীর্তনের অধিকার দিয়েছিলেন।কৃষ্ণ ভজনকে করে তুলেছিলেন সর্বজনীন। বৃহত্তম মানবতার প্রতি ছিল চৈতন্যদেবের গভীর শ্রদ্ধা। চৈতন্যদেবের মিলনকামী ধর্ম ও মানবপ্রেমের বাণী সৃষ্টি করতে পেরেছিল জাতীয় ঐক্য। তাই শুধু হিন্দু সমাজ নয়, মুসলমান সমাজও সমভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল তাঁর প্রতি। তাঁর অহিংস ও মানবিক নীতি ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল মানুষের আত্মবিশ্বাস।

বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের প্রভাব | Literature

 চৈতন্যদেব নিজে সাহিত্য সাধক ছিলেন না। তিনি সংস্কৃত ভাষায় “শিক্ষাষ্টক’ এবং একটি জগন্নাথ স্তোত্র রচনা করেছিলেন। শ্রীভবিষ্যপুরাণে ও শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যেরদেবের কথা বিশেষ ভাবে উল্লিখিত  আছে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যকে তিনি প্রভাবিত করেন গভীরভাবে।এই দেবকল্প মহামানবটির জীবনকথা  তাই বিভিন্ন পদে, গানে, কাব্যে সমাদৃত হয়েছিল আর তাতেই বাংলা সাহিত্যে নতুন দিগন্তের স্বর্ণদ্বার উন্মোচিত হয়।

চৈতন্য আবির্ভাবে যে ভাববিপ্লব এসেছিল, তার সুগভীর প্রভাব পড়েছিল বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যে ।বহু বৈষ্ণব কবি চৈতন্যদেবের ভাগবত জীবন নিয়ে কাব্য রচনা শুরু করলেন এবং সৃষ্টি হল এক নতুন সাহিত্যধারা- শ্রী চৈতন্যজীবনী সাহিত্য। রচিত হলো গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদাবলি ;সাহিত্যে এল এক নতুন জোয়ার।তাঁর যুগান্তকারী আবির্ভাবে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে যে নবজাগরণ সূচিত হয়েছিল , তা সুনিশ্চিতভাবেই বাংলা সাহিত্যের গতিপথকে প্রভূত পরিবর্তিত করেছিল। 

সেই সময়কালে একাধিক কবি চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবন কে অবলম্বন করে  উল্লেখযোগ্য কিছু কাব্য রচনা করে গিয়েছেন। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল: শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর, ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’,শ্রীবৃন্দাবন দাস ঠাকুরের ‘শ্রীমদ্ চৈতন্য ভাগবত’,এবং শ্রীলোচন দাস ঠাকুরের ,’শ্রীশ্রীচৈতন্যমঙ্গল’।

দেহত্যাগ | চৈতন্যদেবের মৃত্যু | Death 

 ভক্তিবলে ভাগবত দর্শনের বিশিষ্ট প্রবক্তা ও প্রচারক শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভু ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথিতে পুরীধামের পুণ্য ক্ষেত্রে  ৪৮ বছর বয়সে পার্থিব শরীর ত্যাগ করে  অমৃতলোকে যাত্রা করেন।

শ্রীচৈতন্যদেবের পাদুকা

নবদ্বীপ শহরে অবস্থিত  ‘মহাপ্রভু ধাম ‘মন্দিরের অভ্যন্তরে শ্রী শ্রী বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতির তত্ত্বাবধানে রাখা অছে শ্রীচৈতন্যর পাদুকা যুগল। কাষ্ঠ নির্মিত   পাদুকা যুগল ৫০০বছর আগে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীকে প্রদান করে গিয়েছিলেন স্বয়ং মহাপ্রভু এবং সেই সময় থেকেই মহাপ্রভুর পাদুকা পূজিত  হয়ে আসছে।  পরবর্তীকালে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর ভ্রাতার   উত্তরাধিকারীরা ও ওই পাদুকা যুগল সুরক্ষিত পরিমণ্ডলে রেখেছেন। ১৯৬০সালের পরবর্তী সময়ে পাদুকা দু’টিকে একটি রূপোর খাপের মধ্যে রাখা হয়েছে বলে জানা যায়।

উপসংহার

মহাপ্রভু অর্থহীন আচার -সর্বস্ব ছিলেন না। কুসংস্কারও ভেদবুদ্ধি তিনি পোষণ করেননি ,সমগ্র মানব সমাজকে এক অখণ্ড জাতি হিসেবে তিনি গণ্য করেছিলেন ।মানুষের একটাই পরিচয় ;”সে মানুষ” এই মহান শিক্ষা আমরা মহাপ্রভুর কাছ থেকেই লাভ করেছি।

সর্ব সংস্কারমুক্ত মানবতাবাদ ও সাম্যের আদর্শকে প্রত্যেক মানুষ যদি  হৃদয়ঙ্গম করতে পারে তবেই তার মধ্যে শ্রীচৈতন্যের জ্যোতির্ময়  চেতনার উদ্ভব ঘটবে। শ্রীচৈতন্যদেবের কথা অনুযায়ী  বর্ণবৈষম্য ও ভেদাভেদ ভুলে এবং  জাতি ধর্ম নির্বিশেষে  মানুষে মানুষে বিশ্বাস এবং জাতীয় সংহতি গড়ে তোলাই হবে সর্বোৎকৃষ্ট ব্রত। এই মহান আদর্শকে মেনে চলতে পারলে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য র প্রতিও সঠিক রূপে সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সম্ভবপর হবে।

(Collected)

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *