গীতায় ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, নিষ্কাম কর্মের কথা – যা হিন্দু ধর্মের মূল কথা। কিন্তু প্রশ্ন এই নিষ্কাম কর্ম বলতে ভগবান কৃষ্ণ কি বলতে চেয়েছেন? গীতায় ফলের আশা ত্যাগ করে কাজ করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য কর্ম করা উচিত, কামনার বশবর্তী হয়ে নয়।
ভগবান কৃষ্ণের পরামর্শ হলো –
কর্ম করা ব্যক্তির অধিকার ও কর্তব্য দুইই। ব্যক্তিকে কর্ম করে যাওয়া উচিত। তবে গীতায় কর্মের প্রতি মমতা ও আসক্তির বিরোধ করা হয়েছে। এখানে যে বিচার প্রচার করা হয়, তা হল—
‘কর্ম করাই তোমার অধিকার, ফলাফলে না, তাই তুমি কর্মফলের বাসনা রেখো না এবং কর্ম ত্যাগ করার বিচার কর না।’ তাই আদেশ দেওয়া হয়েছে যে— ‘মা কর্মফল হেতুর্ভূ’, অর্থাৎ কর্মফলের প্রত্যাশা কর না। কর্মফলের বাসনায় যুক্ত থেকো না, কারণ ‘ফলেসক্তো নিবধ্যতে’ অর্থাৎ ফলের আসক্তির ফলে কর্মবন্ধন দৃঢ় হয়। তাই গীতায় ফলের ইচ্ছা ত্যাগ করে কর্ম করার শিক্ষা দেওয়া হয়। কর্মফলের পরিণামের প্রতি লালসা বা কামনা থেকে বিষয়ের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি পায়। কামনার সিদ্ধিতে বিঘ্ন ঘটলে রাগ উৎপন্ন হয়, রাগের ফলে মতিভ্রষ্ট হয়, অবিবেক জন্ম নেয়।
অবিবেকের ফলে স্মৃতি নাশ হয়, ভালো ও মন্দ বিচারের ক্ষমতা চলে যায় এবং ব্যক্তি নিজের জন্য শ্রেষ্ঠ বস্তু নির্বাচন করতে পারে না। এই ভাবে ব্যক্তি কর্মবন্ধনে আটকে যেতে থাকে। কর্ম করার প্রক্রিয়া উদ্দেশ্য থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া উচিত, তা কামনা দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত নয়। এবার প্রশ্ন হল, কর্মফলের ইচ্ছা ও কামনা ছাড়া কর্মের প্রবৃত্তি কেমন হবে? ফলের আশা না-করে ব্যক্তি কী ভাবে কর্ম করতে পারবে? বলা হয়েছে, কামনা পূরণের জন্যও কর্ম করা হয় আবার কামনার নিবৃত্তির জন্যও কর্ম করা হয়। সামান্য ব্যক্তি কামনা পূরণের জন্য কাজ করেন, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি আসক্তি ত্যাগ করে আত্মশুদ্ধির জন্য কর্ম করেন।
এই কর্ম সম্পর্কে ভগবান কৃষ্ণের ব্যাখ্যা হলো – কর্ম সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, স্বার্থ চিন্তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কর্ম করলে সমস্ত ধরণের বিকৃতি আসে। স্বার্থ থাকলে কর্ম তুচ্ছ ও বন্ধনকারক হয়ে পড়ে। কিন্তু বন্ধন ভেঙে মোক্ষ লাভ করা মানুষের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য স্বহিতের ইচ্ছায় করা কাজ অভীষ্ট হয় না। আমাদের কাছে যত বোধ, সময়, সামর্থ্য ও সামগ্রী আছে, তা দিয়েই অন্যের সেবা করলে, সেই সেবা লোকহিতকারী হবে। অন্যের হিতের জন্য যে কাজ করা হয় তাকে লোকসংগ্রহ বলা হয়। গীতায় স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, আসক্তি মুক্ত থেকে লোকসংগ্রহকে মাথায় রেখে কাজ করলে ব্যক্তির সংসিদ্ধি হয়।