বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পার্বণ। ছোট থেকে বড়, যেরকম উৎসবই হোক না কেন, পাত পেড়ে অতিথিকে বসিয়ে খাওয়ানোটা সবেতেই দেখা যায়। আর কয়েক মাস বাদেই তেমন এক উৎসব আসছে। এক দিনের উৎসব হলেও খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত করতে অনেক বাঙালি মা-ই দু’তিনদিন ব্যয় করেন। জামাইষষ্ঠী। বাড়িতে মেয়ে আর জামাইকে আপ্যায়ণ করে মায়েরা রকমারি খাবার খাওয়ান। বহু প্রাচীনকাল থেকে এই নিয়ম রীতি পালন করা হচ্ছে। বিবাহিত মেয়েদের বাড়িতে তাঁদের স্বামীকে সম্মান জানানোর জন্য উদযাপন করা হয়।
দেবী ষষ্ঠী দ্বিভুজা, বরাভয়দায়িনী, গৌরবর্ণা, অলঙ্কারভূষিতা, দিব্যবসন পরিহিতা, নিত্যা, জগদ্ধাত্রী, সন্তান প্রদা, সর্ব সুলক্ষণ সম্পন্না। মা ষষ্ঠী বামক্রোড়ে পুত্র ধারন করে থাকেন, যা মাতৃত্বের পরিচয়। বলা হয়, সকল মাতৃত্বের গুণ নিয়েই মা ষষ্ঠী আবির্ভূতা হন। মা ষষ্ঠীর ব্রত পালন করা হয় সন্তান প্রাপ্তি ও তাদের মঙ্গল কামনায় মায়েরা এই ব্রত করেন। এই বছর জামাইষষ্ঠী ব্রত পালন করা হবে বাংলার ২৯ জৈষ্ঠ্য এবং ইংরেজির ১২ জুন ২০২৪, বুধবার।
সন্তানের মঙ্গল কামনার্থে অনেকেই দেবী ষষ্ঠীর পুজো করে থাকেন। কিন্তু জানেন কী, ষষ্ঠীদেবীর (Sasthi) পুজো করার কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে, যা মেনে চললে মা ষষ্ঠীর কৃপা লাভ করতে পারবেন। দেখে নিন কোন পদ্ধতিতে পুজো করলে ষষ্ঠীদেবীর আশীর্বাদ মিলবে। এই দেবীর নির্দিষ্ট অবয়ব নেই। মঙ্গল ঘটে আঁকা মূর্তি, শিল, পিটুলি দিয়ে তৈরি মূর্তি, ঘটে পোঁতা বটগাছের ডাল ইত্যাদিতে ষষ্ঠীদেবীর প্রতিমা কল্পনা করা হয়। দেবীর বাহন কালো বিড়াল। প্রাচীন লোকবিশ্বাসের সূত্র ধরেই নাকি ষষ্ঠীর বাহন বিড়াল।
বাংলা পঞ্জিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব জামাই ষষ্ঠী (Jamai Sasthi) । প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে পালিত হয়। বাংলা পঞ্জিকা (Bengali Panchang) অনুসারে, এবার জামাই ষষ্ঠী পালিত হবে, জুন মাসের ১২ তারিখ, শুক্রবার, জৈষ্ঠ মাসের ২৯ তারিখ। তবে অনেকেই এদিন আচার পালন করলেও খাওয়া-দাওয়া জমায়েত করেন কাছাকাছির কোনও একটি ছুটির দিনে। তাই জামাই ষষ্ঠীর আশেপাশে ছুটির দিনগুলোতে বাজার দর থাকে বেশ আকাশছোঁয়া।
সারা বছরে ষষ্ঠী পুজোয় নিজের সন্তানদের মঙ্গল কামনাই হয়ে ওঠে মুখ্য। বেচারা জামাই থাকে বাইরে। তাই শুধু মাত্র অরণ্যষষ্ঠীতেই (Aranya Sasthi) জামাইদের এই স্পেশাল খাতির। আবার অনেকের মত জৈষ্ঠমাসে কৃষ্ণপক্ষের সাবিত্রী চতুর্দশী তিথিতে স্ত্রীরা স্বামীদের দীর্ঘজীবন কামনা করে যমের আরাধনা করতেন। এই লোকাোচারটির সূত্র ধরেই কলকাতার বাবু সংস্কৃতিতে নাকি জামাই ষষ্ঠীর সূচণা।
ষষ্ঠী পুজোর উপকরণ-
সিন্দুর, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চগব্য, পঞ্চশস্য, আম্রশাখা, ঘট, বটের ডাল, তিল, হরিতকী, পুষ্প, দূর্ব্বা, তুলসী, বিল্বপত্র, ধূপ, দীপ, ধুনা, আসনাঙ্গুরীয়ক, মধুপর্কের বাটী, দধি, মধু, চিনি, নৈবেদ্য, কুচা নৈবেদ্য, ষষ্ঠীর শাটী, মার্কণ্ডেয়ের ধুতি, মন্থনদন্ড, তীর, ধনু, পিটুলি অঙ্কিত হাঁড়ি, পিটুলি অঙ্কিত পুত্তলিকা, শ্বেতসর্ষপ, মাষতলাই, বটের পাতা, পাখা, হরির দ্বাদশ নাম লিখিবার জন্য শুভ্র (শ্বেত) বর্ণের নূতন বস্ত্রখণ্ড, কাঁচাহলুদ, ঘৃতপ্রদীপ, আঁতমরা ফল, লোহা, ঘুনসি, তালপত্র, গোমুন্ডের পূজা, ব্রাহ্মনের পদধূলি, মিষ্টান্ন, পুরোহিতের দক্ষিণা-সহযোগে দেবী ষষ্ঠীর পুজো করলে তিনি খুশি হন।
ষষ্ঠী পুজোর ধ্যান মন্ত্র-
ওঁ গৌরাভাং দ্বিভুজাং ষষ্ঠীং নানালঙ্কার-ভুষিতাম্। সর্ব্বলক্ষণ-সম্পন্নাং পীনোন্নতপয়োধরাম্।। দিব্যবস্ত্রপরীধানাং বামক্রোড়ে সপুত্রিকাম্। প্রসন্নবদনাং ধ্যায়েজ্জগদ্ধাত্রীং সুখপ্রদাম্।।
ষষ্ঠী পুজোর প্রণাম মন্ত্র –
জয় দেবি জগন্মাতর্জ্জগদানন্দকারিণি। প্রসীদ মম কল্যাণি নমস্তে ষষ্ঠী দেবিকে।।
জামাই ষষ্ঠী উদযাপনের পিছনে রয়েছে একটি গল্প। বিড়াল মা ষষ্ঠীর বাহন। তার উপর উৎপাত করলে দেবী যান চটে। একবার হয়েও ছিল তাই। এক লোভী মহিলা ছিলেন। তিনি চুরি করে খেতেন আর যাবতীয় দোষ চাপিয়ে দিতেন বিড়ালের উপর। বিড়াল বেচারা দোষ না করেও মারধর খেত। তা নিয়ে বিড়ালের ভারী কষ্ট। সে তো একদিন মা ষষ্ঠীর কাছে কেঁদে কেটে একাকার করল। তখন মা ষষ্ঠী ওই মহিলাকে শাস্তি দেবেন ঠিক করলেন। মা ষষ্ঠী ছল করে তাঁর সন্তানদের তাঁর কাছ থেকে একদিন সরিয়ে নিলেন। সেই মহিলার তখন পাগলের মতো অবস্থা। অপারগ হয়ে তিনি দেবীর কাছে দয়া ভিক্ষা করেন। তখন দেবী ষষ্ঠী বলেন, সন্তানদের ফিরে পেতে গেলে জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠ দিনে জামাই ষষ্ঠী পালন করতে হবে। তার পর থেকেই বাঙালির জামাইষষ্ঠী পালন শুরু। এই হল জামাইষষ্ঠীর ব্রত কথা। এই ষষ্ঠীকে অরণ্য ষষ্ঠীও বলা হয়ে থাকে।
ব্রত পালনের জন্য লাগবে –
- তাল পাতার পাখা
- দূর্বা
- ধান
- মিষ্টি
- সুপারি
- করম চা
- ফুল, বেলপাতা
- আম্রপল্লব
- হলুদ মাখানো সুতো
(collected)