মহালয়া, মহালয়া অমাবস্যা বা সর্ব পিতৃ অমাবস্যা নামেও পরিচিত, ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব। এটি দুর্গা পূজার শুরু এবং ‘পিতৃপক্ষ’ এর সমাপ্তি চিহ্নিত করে। এই বছর, মহালয়া 2রা অক্টোবর 2024, একটি বুধবার। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, কর্ণাটক এবং ত্রিপুরায় ভক্তি ও উৎসাহের সাথে দিনটি উদযাপিত হয়।
মহালয়া অমাবস্যা দেবী দুর্গার জাগরণকে বোঝায়। এটা বিশ্বাস করা হয় যে মহিষাসুর, অমরত্বে আশীর্বাদপ্রাপ্ত এক অসুর রাজা, তিন জগতে সর্বনাশ করেছিলেন। দেবতারা ত্রিত্বের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন – ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ। তাদের সম্মিলিত ক্রোধ দেবী দুর্গার রূপ নিয়েছিল, যিনি এই দিনে মহিষাসুরকে পরাজিত করেছিলেন।
মহালয়া কি শুভ না অশুভ
পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনালগ্নটি মহালয়া হিসেবে চিহ্নিত। এই সন্ধিক্ষণ মানব জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মহালয়া অর্থাৎ মহান যে আলয়, এই কথাটির ব্যাখ্যা নানা ভাবে করেছেন প্রাজ্ঞজনেরা। যেহেতু মহালয়া থেকেই দেবী দূর্গার আবাহন মুহূর্তটি চিহ্নিত হয়ে যায়, তাই অনেকের মতে দেবী স্বয়ং হলেন এই আলয় বা আশ্রয়। ভিন্নমতে, এই মহান আলয় হল পিতৃলোক। যেহেতু এটি পিতৃপক্ষের অবসান চিহ্নিত করে। ঠিক এর পরদিন থেকে দেবীপক্ষের সূচনা।
পিতৃপক্ষের এক পক্ষকাল পিতৃপুরুষরা মনুষ্যলোকের কাছাকাছি চলে আসে। পুরাণমতে, ব্রহ্মার নির্দেশেই গড়ে ওঠে এই মহামিলনক্ষেত্রটি। এই সময় তাই পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করে মানুষ। শাস্ত্রমতে, হিন্দুদের অবশ্য পালনীয় যে পঞ্চমহাযজ্ঞের বিধান রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল পিতৃযজ্ঞ অর্থাৎ তর্পণাদি। এই তর্পণ কথার অর্থ হল, যাতে অন্যের তৃপ্তি হয় সেই উদ্দেশ্যে জলদান। তর্পণ তাই শুধু পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যেই নয়, সর্বভূতের উদ্দেশেই করতে হয়। তর্পণের মন্ত্রের ভিতরই নিহিত রয়েছে সেই নির্দেশ-
আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তং দেবর্ষিপিতৃমানবাঃ।
তৃপ্যন্ত পিতরঃ সর্বে মাতৃমাতামহোদয়ঃ।।
আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তং জগৎ তৃপ্যতু।

অর্থাৎ, দেবগণ, ঋষিগণ, পিতৃগণ, নরগণ – ব্রহ্মা হইতে তৃণশিখা পর্যন্ত সমস্ত জগৎ আমা কর্তৃক প্রদত্ত অন্নজলে তৃপ্তিলাভ করুন। এই হল তর্পণের গূঢ় কথা। শাস্ত্র বলে, সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম- অর্থাৎ, সমস্ত জগৎ ব্রহ্মময়। তাই জলদান করতে হয় সর্বভূতের উদ্দেশ্যেই। যেহেতু পিতৃপক্ষে পিতৃলোক ও মনুষ্যলোক কাছাকাছি চলে আসে, তাই ধারণা করা হয়, এই সময়কালে যদি পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ অর্থাৎ জলদান করা হয়, তবে তা তাঁদের কাছে সহজে পৌঁছায়। যার মহাপ্রকাশ পিতৃপক্ষের শেষ দিনটিতে অর্থাৎ মহালয়ায়। এই কারণেই পিতৃপক্ষের অবসানে মানুষ তর্পণে রত হন। মহালয়ার এক অর্থ যে পিতৃলোক, তা এই ধারণা থেকেই উঠে এসেছে। একই সঙ্গে পিতৃপক্ষের অবসানে, দেবীপক্ষের সূচনাও যেহেতু চিহ্নিত হয়, তাই মহালয়া অর্থে মা দুর্গাকেই আশ্রয় ধরা হয়। শাস্ত্রে কথিত আছে, এই দিনেই মহিষাসুর বধের দায়িত্ব গ্রহণ করেন দেবী দুর্গা। মহিষাসুরের কবল থেকে দেবগণকে উদ্ধার করার লগ্ন যেহেতু এখান থেকেই সূচিত হচ্ছে, তাই পরমা প্রকৃতি বিশ্বজননীর আশ্রয়ই হল মহান আলয়, এমত মত পোষণ করেন অনেকে।
মহালয়া শুভ না অশুভ, এ নিয়েও তর্ক কম নেই। কেউ কেউ বলে থাকেন, এই দিনটি শুভ নয়। যেহেতু এইদিন পিতৃপুরুষের স্মরণ করা হয়, তাই প্রকৃতপক্ষে এ আসলে শোকের দিন। দিনটিকে সেহেতু শুভ বলে চিহ্নিত করা সঙ্গত নয়। মতান্তরে, হিন্দু শাস্ত্রে যে কোনও শুভ কাজের সূচনাতেই পিতৃপুরুষকে স্মরণ বা তর্পণ করা হয়। যে রীতি হিন্দুর নিত্য পঞ্চমহাযজ্ঞের অন্তর্গত, তাকে অশুভ বলাও বাঞ্ছনীয় নয়। যদি তর্পণের বৃহত্তর অর্থটি ধরতে হয়, তা আসলে ইঙ্গিত দেয় জগৎব্যাপী এক মহামিলনক্ষেত্রের। মিলনের এই মুহূর্ত এবং তার উৎযাপন তাই কোনোভাবেই অশুভ হতে পারে না।
প্রাথমিক কথা
প্রলয়কালে পৃথিবী এক বিরাট কারণ-সমুদ্রে পরিণত হলে শ্রীবিষ্ণু সেই সমুদ্রের উপর অনন্তনাগকে শয্যা করে যোগনিদ্রায় মগ্ন হন। এই সময় বিষ্ণুর কর্ণমূল থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুই দৈত্য নির্গত হয়ে বিষ্ণুর নাভিপদ্মে স্থিত ব্রহ্মাকে বধ করতে উদ্যত হল। ভিত হয়ে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে জাগরিত করবার জন্য তাঁর নয়নাশ্রিতা যোগনিদ্রাকে স্তব করতে লাগলেন। সৃষ্টি হয়ে দেবী শ্রীবিষ্ণুকে জাগরিত করলে তিনি পাঁচ হাজার বছর ধরে মধু ও কৈটভের সাথে মহাযুদ্ধে রত হলেন। পিতৃপক্ষ আর দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণ হচ্ছে মহালয়া।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ (Krishna) প্রতিপদ শুরু হয়ে পরবর্তী অমাবস্যা পর্যন্ত সময়কে পিতৃপক্ষ বলে। পুরাণ মতে ব্রহ্মার নির্দেশে পিতৃপুরুষরা এই ১৫ দিন মনুষ্যলোকের কাছাকাছি চলে আসনে। তাই এই সময় তাঁদের উদ্দেশ্যে কিছু অর্পণ করা হলে তা সহজেই তাদের কাছে পৌছায়। তাই গোটা পক্ষকাল ধরে পিতৃপুরুষদেব স্মরণ ও মননের মাধ্যমে তর্পণ করা হয়। যার চূড়ান্ত প্রকাশ বা মহালগ্ন হল মহালয়া, পিতৃপক্ষের শেষ দিন। পরের দিন শুক্লা প্রতিপদে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। সেই দিন থেকে কোজাগরী পূর্ণিমা পর্যন্ত ১৫ দিনই হল দেবীপক্ষ।

দেবীপক্ষের সূচনা
যা চন্ডি মধুকৈটভারী, দৈত্য দলনী, যা মহিষমর্দিনী, যা দূর্গে চন্ড মুন্ডোমালিনী,যা রক্ত বিজশ্বরী,শক্তি সুন্দরী সুন্দর দৈত দলনী—যা—। আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেঁজে উঠেছে আলোক মঞ্জিল, ধরনীর বর্হিআকাশে-অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তর আকাশে জাগরিত জোর্তিময়ী জগত্মাতার আগমন বার্তা, আনন্দময়ী মহামায়ার পদ্ধধ্বনি অসিম ছন্দে বেজে ঊঠে রুপলোক ও রশলোকে আনে নবভাব মাধুরীর সঞ্জিবন, ত্রাহি আনান নন্দিতা শামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে-মৃন্ময়ীকে আবাহন। আজ শক্তিরুপীনি বিশ্বজননীর শারদও শ্রীমন্ডিত প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানগ্রহিতা। মহামায়া-সনাতনী শক্তিরুপা গুনাময়ী-হে ভগবতী মহামায়া তুমিই ত্রিগুনাতিকা, তুমিই রজগুনে ব্রহ্মার গৃহিনী বাগদেবী,শপ্তগুনে বিহ্মœুর পতিœ লহ্মি, তমগুনে শিবের বনিতা পাবর্তী,আবার ত্রিগুনাতিত তুমিই অর্নিবচ্চনিয়া, আবার দেব ঋষি কণ্যা কাত্যায়নের কণ্যা কাত্যায়নী, তিনিই কণ্যাকুমারী আখ্যাতা দূর্গে, তিনিই দাক্ষ্যয়নি সতি, তিনিই আদিশক্তি, দেবী দূর্গা নিজদেহ সম্ভুত তেজপ্রবাহে শত্রুদহনকালে অগ্নিবর্ণা, অগ্নি লোচনা, এই উষা লগ্নে—হে মহাদেবী তোমার উদ্বোধনে প্রানের ভক্তিরশে আলোকিত হোক দিকে দিকে, হে অমিতজ্যোতি, হে মা দুর্গা, তোমার আবির্ভাবে ধরনী হোক প্রাণময়ী, জাগো জাগো মা।
জাগো দশপ্রহরণ ধারিণী
জাগো দুর্গা, (Durga) জাগো দশপ্রহরণ ধারিণী, অভয়াশক্তি বল প্রদায়নী তুমি জাগো-দেবী প্রসীদ পরিপালয়ে নো হরি ভীতে: নিত্যং যথাসুরবধদিধনৈব সদ্য: পাপানি সর্বজগতাঞ্চ শমং নয়াশু উত্পাতপাকজনিতাংশ্চ মহোপসর্গানা। পূত পবিত্র এই আহবানের মধ্যে দিয়ে আজ দিবাগত রাতের শেষে ভোরে (১৪ অক্টোবর শনিবার)সারাবিশ্বে পালিত হবে পূণ্য তিথি মহালয়া। আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত হবে মহিষাসুরমর্দ্দিনী। বাণী কুমারের রচনা ও প্রবর্তনায় মাতৃসাধক বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের অমর কন্ঠের গ্রন্থনা ও শ্লোক পাঠে আবাহন হবে জগত্ জননী দেবী দূর্গার। দূর্গায়ে দূর্গপারায়ৈ সারায়ৈ সর্ব্বকারিণ্যৈ, খ্যাত্যৈ তথৈব্য কৃষ্ণায়ৈ ধুম্রায়ৈ সতত: নম:- মাতৃবন্ধনার এ আহবানে পবিত্র পূণ্যতিথি মহালয়া। শারদীয় দূর্গাপুজার সপ্তাহকাল পূর্বে মায়ের আরাধনা বন্ধনায় মহালয়া পালিত হবে।
চন্ডী পাঠ
শাস্ত্রমতে মহালয়া (Mahalaya) হচ্ছে একটি অমাবস্যা তিথি, এ তিথিতে সাধারনত পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ তর্পণ করা হয়। এ দিন তর্পণ করলে পিতৃপুরুষরা নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে আমাদের আর্শিবাদ প্রদান করেন। এছাড়া মহালয়ার দিনে দেবী দূর্গার বোধন করা হয়,বোধন অর্থ জাগরণ। তাই মহালয়ার পর দেবীপক্ষের/শুক্লপক্ষের প্রতিপদে ঘট বসিয়ে শারদীয় দুর্গাপূজার সুচনা করা হয়। শ্রাবন থেকে পৌষ ছয় মাস দক্ষিনায়ণ,দক্ষিণায়ণ দেবতাদের ঘুমের কাল। তাই বোধন করে দেবতাদের জাগ্রত করা হয়। মহালয়ার পর প্রতিপদে যে বোধন হয় সে সময় সংকল্প করে দুর্গাপূজার আয়োজন চলে। একে বলে কল্পরম্ভা, যদিও ষষ্ঠি থেকে পূজার প্রধান কার্যক্রম শুরু হয় তাই বলা হয় (Chandi) ষষ্ঠাদিকল্পরম্ভা। এবং সপ্তমী থেকে বিগ্রহতে। প্রতিপদ থেকে শুধু ঘটে পূজো ও চন্ডী পাঠ চলে।
(Courtesy-Wiki & several articles)